“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১৮

জয়া



চলেছিলাম  মহাসড়ক দিয়ে, হাফলংএর পথে

ওখানে একটা টেন্ডার দিতে হবে জমা, আজকেই 

কাজটা বিশাল, পঞ্চাশ কোটির কারবার 

সকালেই  বেরিয়েছি, আমি আর ড্রাইভার 

চালাচ্ছে ওই । আমি পেছনের সীটে বসা ।

ঘড়িতে কটা হবে ? সাতটা অথবা সাড়ে সাতটা 

ছুটছে গাড়ি মহাসড়কে । মসৃণ ফাঁকা রাস্তা 

আমি বললাম, "এই একটু সামলে চালা ।

হঠাৎই রাস্তার পাশে গোল এক জটলা

লোকজন আশেপাশে ছড়ানো ছিটানো 

দেখি অধিকাংশই তার গ্রামীণ মহিলা 

 ড্রাইভারকে বলি , " এই গাড়ি থামা এইবার।"

ড্রাইভার আস্তে বলে, "স্যার, টেন্ডার ।"

আমি বলি , " দাঁড়া, সে না হয় হবে ক্ষণ 

আগে বুঝে নিতে দে কেসটা কি বিলক্ষণ।"

ধীর পায়ে এগিয়ে যাই ভীড়টির পাশে

দেখি একটি বছর কুড়ির মেয়ে, 

আধমরা শুয়ে অবিন্যস্ত পোশাকে, 

অবিরাম রক্ত ঝরছে কান মাথা  দিয়ে 

দুরে পড়ে আছে একখানা স্কুটি,

 হয়তো মেয়েটির । আমি চমকে উঠি , 

এ কেমন কথা । মেয়েটা মৃত্যুশয্যায়

এদিকে  শলাই চলছে এ কঠিন  অবস্থায়

জিজ্ঞেস করি, " কতক্ষণ? "---"হবে মিনিট দশ"

"সেকি এখনো এভাবে পড়ে,  হাসপাতাল নিতে হবে যে --।"

"হ্যাঁ পুলিশে খবর গেছে, কিছু একটা হবে ---"

কিন্তু ততক্ষণে -- । ততক্ষণে যদি কিছু ঘটে ?

এক লহমায় ভেবে নিই কি করা উচিত ।

আমার হাফলংএ যাওয়া, টেন্ডার সাবমিট 

পরিমাণ কম নয়, একেবারে পঞ্চাশ কোটি।

এদিকে অচেনা জায়গা,  অপরিচিত মহিলা  

তাছাড়া দুর্ঘটনাতে  আছে পুলিশি ঝামেলা ।

পরক্ষণেই মনে হয়, কি কথা হে ভাবছি

দুই হাতে তুলে নিয়ে মেয়েটিকে কোলে

সোজা ছুটে যাই আমার গাড়ি যেইদিক 

ড্রাইভার ধীরে বলে, "স্যার, টেন্ডার ।"

আমি বলি, "চুপ, কথা নয় আর, 

গাড়ি ঘোরাও। এক্ষুনি যেতে হবে সদর হাসপাতাল

মেয়েটিকে বাঁচাতে হবে, এখনো উত্তাপ আছে গায়।"

মেয়েটির মাথা খানা নিজ কোলে নিয়ে 

হালকা জলেতে দিই মুখখানি ধুয়ে

গলগল ধারায় ক্রমাগত রক্ত ক্ষরণ 

ফিরে ফিরে ঈশ্বরেরে করিতেছি স্মরণ 

হে ঈশ্বর, হে বিধাতা, হে সর্বশক্তিমান 

দয়া কর, দয়া কর প্রভু এই বাছারে,

দয়া করে কর প্রভু পুনর্জীবন দান ।

হয়তো জলের স্পর্শে আর খোলা ঠান্ডা হাওয়ায়

ধীরে ধীরে অতি কষ্টে  মেয়েটি চোখ মেলে চায়

দুহাতে প্রণমি বলি হে ঈশ্বর তুমি করুণাময়

পাশে থেকো প্রভু তুমি যেন শেষ রক্ষা হয়।

হঠাৎই নজরে আসে মেয়েটি রক্ত মাখা হাতে 

শার্টের কোনায় ধরা কিছু বলবার তরে।

আমি ওকে সান্ত্বনা দিই , "ভয় পেও না  মা, 

আমি আছি তোমার পাশে, কিচ্ছু হবে না ।"

মেয়েটি ক্ষীণ স্বরে বলে, "কাকু আমি জয়া  -"

আমি বলি , "বাড়ি কোথায় ? কে আছে তোমার? "

মেয়েটি কষ্টে বলে, "কাকু আমি বাঁচবো না আর ।"

-- " ছিঃ মা এমন বলতে নেই । এই কথা বলিস না।

হাসপাতাল পেলামই বলে, চিন্তা করিস না মা ।"

অতিকষ্টে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়েটি বলে,

"কাকু তুমি কথা দাও এই আমায় ছুইয়ে, 

যদি আমি না থাকি আরো ক্ষাণিক পরে --।"

আমি বলি , "চুপ কর চুপ কর  মা, এ কেমন কথা? 

ফিরায়ে আনবো নিশ্চয়ই যদি সহায় বিধাতা ।"

মেয়েটি ধীরে  বলে , " কাকু কথা দাও মোরে 

আমি যে বাঁচতে চাই কাকু এই ধরার পরে।

দেহদান করেছিলাম বহু দিন আগে 

কথা দাও  থাকবে পাশে সেই ইচ্ছা পুরনে ।"

দুই হাতে শক্ত করে ধরি হাতখানি 

বলি, "কথা দিলাম, কথা দিলাম আমি 

এই চন্দ্র সুর্য সাক্ষী, যদি অঘটন কিছু ঘটে 

তোর দেহ পৌঁছে দেব তোর যথাস্থানে ।"

--" আঃ কাকু কি শান্তি, কি শান্তি পেলাম ।

 জীবনের শেষ প্রান্তে ঋণী থেকে গেলাম ।"

কথাটা শেষও হয়নি  হালকা হাসি মুখে 

চিরনিদ্রায় যায় জয়া আমারই বুকে।








কোন মন্তব্য নেই: