“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭

বিদায়


         ।।         রফিক উদ্দিন লস্কর         ।।

(C)Image:ছবি









ড়ির কাঁটা চলছে জোরে সময় নাহি বেশিক্ষণ,  
পুরাতন বর্ষ চলে যাবে ঘটবে নববর্ষের আগমন।
কেটে যাবে আজিকার দিন কিছুটা ঘণ্টা পরে,
পুরানো বছর লইবে বিদায়, সময়ের হাত ধরে।
মূল্যহীন হয়ে যাবে দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডার,
সরে যাবে দূরে যতই থাকুক তার রূপের বাহার।
সুখেদুঃখে পাশে ছিলো কিন্তু আজ বিষাদে মলিন,
কাল থেকে সে হবে গৃহহারা, ঠাঁই হবে ডাস্টবিন।
ঘরে সাজানো ফুলদানিরা আজ মনে মনে ভাবে;
কতো স্মৃতি জড়ানো তারা মন থেকে মুছে যাবে।
এমনি ধারায় পার হয়ে গেছে আজ অনেকটা বর্ষ,
বিদায়ে ভাসে চোখের জলে, নবীনেরা করে স্পর্শ।
পুরানো দিনের কথা ভেসে উঠে স্মৃতির আয়নায়,
মনের গভীরে ছন্দে বাজে গীত আজ বর্ষ বিদায়।


৩১/১২/২০১৭ইং
নিতাইনগর, হাইলাকান্দি (আসাম-ভারত)

শনিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭

শীতলক্ষ্যা

।। দেবশ্রিতা চৌধুরী।।

(C)Image:ছবি
















শীতলক্ষ্যা অদেখা প্রিয় তুমি
বিরহী কবির ছোঁয়া অনুভবে ....
জন্মভূমির বিরহের আগুনে জ্বলে
যাওয়া যার,তুমি যেন এক মধুর নারী
কচুরিপানার ফুলের রঙের গাত্রবর্ণ
টানা ডাগর চোখে শান্তশ্রী,একঢাল 

কালোচুলে তার পৃথিবীর সন্ধ্যা ঘনায়
নয়তো চরাচর আঁধারে ঢেকে বৃষ্টি
ফোঁটার প্রথম বিন্দুটি যেমন মাটিকে
ভালোবেসে সোঁদা গন্ধে ভরে দেয়
তেমন মাতাল মাতলামি।
কার্যকারণ না বুঝেই জানি শ্যামলা নারী
শীতল হয়,স্পর্শে একদণ্ড শান্তিতে
ভরে দেয় তাপিত প্রাণ
দেখা হয়নি হয়তো হবেনা কোনদিন
স্বপ্নে দেখেছি বহুবার
তবুও শীতলক্ষ্যা বন্ধুর হাতে হাত রেখে
রেখে যাই একটুকরো পরিযায়ী দাগ।

শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭

ব্যথা

।। অভীক কুমার দে।।
(C)Image:ছবি




















.
খন দু'পত্র মেলবো বলে
কথা দিয়েছি বাতাসের কাছে
কারা যেন গন্ধ শুঁকে খুঁটে দেখছে বীজ !
বুকভরা ব্যথা জমা করি মাটির কাছে।
কেন জানি মাটিও নীরব
চেয়ে থাকে পচন আমার আর ক্ষত ঢাকে
কারা যেন তখনও খুঁটে নির্যাস !
....................

বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৭

শীত এসেছে


        ।।       রফিক উদ্দিন লস্কর     ।।

(C)Image:ছবি










শীত এসেছে ভাই ওরে.. লাগলো কাঁপন গায়,
সোনার মাঠে হিমেল হাওয়া গান গাহিয়া যায়।
শীত এলো হিম-কুয়াশা আর সাদা চাদর নিয়ে,
এবার শীতের বুড়ি যাবে বাড়ি হামাগুড়ি দিয়ে।
খেজুর গাছে রসের হাড়ি ঝুলছে সারি সারি,
এই রসেতে বনবে পিঠা , নয়কো বেশি দেরি।
 
খেজুর গুড়ে ভাপা পিঠা ,তুলনা নেই জানি,
শীতের দিনে মজা নিতে জিভে আসে পানি।
গ্রামগুলোতে শীতের দিনে মিলে অনেক সাড়া,
চলবে মেলা যাত্রাপালা, সেজে উঠছে পাড়া।
 
আলসেমিতে শীতসকালে চায়না কাটতে ঘুম,
মিষ্টি রোদ তাই সকালবেলা দেয় কপালে চুম।
সকালবেলা রোদের পরশ শীতকে তাড়ালো,
শিশিরভেজা শীতের সকাল লাগে তাই ভালো।
শীতের সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়ি গায়ে দিয়ে চাদর,
সবাই বসি জটলা করি নেই আগুনের আদর।
.........

২৮/১২/২০১৭ইং
নিতাইনগর, হাইলাকান্দি (আসাম-ভারত)

একমুঠো সুখ


      ।।   রফিক উদ্দিন লস্কর   ।।

(C)Image:ছবি





















কমুঠো সুখ খুঁজিতে খুঁজিতে হায়,
সুখ যে আসেনা মোর আপন ভিলায়।
সুখের খুঁজে তার পিছনে শুধু ছুটে বেড়াই,
সেখানে ও গিয়ে দেখি সোনার হরিণ নাই।
হায়রে উদাসী আমার মন পাগলা...
 
কিসের নেশায় এই মরীচিকার পেছনে ছুটে চলা।
 
কাহার পানে মন ছুটে যায় বুকভরা আশা নিয়ে,
সুখ সে তো দূরের কথা, হাসি গুলো যায় লুকিয়ে।
 
মিথ্যে স্বপ্ন আশার ঘরে বুকে আগলে,
তাসের ঘরে ভাসি এখন চোখের জলে।
যাকে নিয়ে বুনন ছিলো এতো স্বপ্ন তোর,
 
সেতো এখন ভাঙ্গেরে তোর স্বপ্নের সেই ঘর।
আজ ব্যথার বোঝা হয়েছে যে পাহাড় সমান,
কালো কষ্ট মেঘে ঢাকা ঐ মনের নীল আসমান।
মিছে আশা আর বিশ্বাসে তুই হয়ে যাচ্ছিস অন্ধ,
তাই দিনে দিনে হয়ে যাচ্ছে তোর সুখের দরজা বন্ধ।
কেমনে খুলিবে সেই বন্ধ দরজা ওরে....
বিশ্বাসের তালায় যদি কোনদিন
  মরিচা ধরে। 
সুখের দরজা বন্ধ হলে আর গাইবো না কোন গান,
পড়ে রবে নিথর দেহ, থাকিবে না তাতে প্রাণ।
                          --------------
২৮/১২/২০১৭ইং
নিতাইনগর,হাইলাকান্দি
  (আসাম-ভারত)

বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭

ভেতর ভেতর খুঁজি

।। অভীক কুমার দে।।


(C)Image:ছবি






















.
নের ভেতর থাকো জেগে
তোমার মনের আমি,
আমি'র ভেতর খুঁজে দেখি
নিজের মনই দামি।
বাতাস বাতাস উষ্ণ শীতল
শূণ্য থেকে ছন্দে,
যখন তখন তাল কাটে তার
হিসেবনিকেশ দ্বন্দ্বে।
জীবনবেলায় কতক খেলায়
ভেতর ভেতর খুঁজি,
চলন শেষে ধোঁয়ায় মেশে
তোমার আমার পুঁজি।

জলের মানুষ

।। অভীক কুমার দে।।


(C)Image:ছবি















.
রোজ ঝড় ওঠা বুক সমুদ্র যেমন,
নোনাজল ভেবে নামতে চায় না কেউ,
অথচ বাতাস জানে মরুশুষ্কতা কেমন।
.
নদীর উপর সাঁকো বাঁধা
চাঁদের আলোয় দেখছে রাত,
জলের ধারায় কাঁপছে ছবি
ভেতর জানে সন্ধিবাত।
.
শুকিয়ে গেলে নদী আমার
নৌকো রেখো পাড়ে,
মাঝি তুমি,
'জলের মানুষ' বুঝিয়ে দিও তাঁরে।

ফাঁকা

।। অভীক কুমার দে ।।


(C)Image:ছবি














কাকভোর, কালোর ঘরে আলো প্রসব,
গোধূলিবেলায় আলোর ঘরে কালো,
দুদিকেই বেড়ে ওঠে দৃশ্য আর অদৃশ্যের ধাঁধা কবর।
.....

সাদা পায়রা উড়বে বলেই ডানায় মাখি রোদ
অথচ অকাল কুয়াশায় ঢেকে যায় আকাশ !
.....

একদিন মনের উঠোনে ঝাপসা চাঁদ,
গল্প শোনায় শীত,
উষ্ণতা হারায় বুক আর কেঁপে ওঠে।
.....

অসংখ্য হোঁচটের পর বিন্দু থেকেও জীবন
স্পষ্ট হতে হতেই উড়ন্ত পাখি আবার হারায় বিন্দুতে
মাঝে লাটাই ঘোরানো শব্দ।

ব্যঙ্গচিত্র

।। অভীক কুমার দে।।
(C)Image:ছবি

.
ত কিছুই দেখছি ! পাবলিসিটির পর্দা থেকে এ'পর্যন্ত। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটা-রাস্তা বদলে গেলেও উদ্দেশ্য আর পথ আজও একই। ফোসকা পড়ে জল গলছে, ধুলোবালি মিশে পা পচে গেলেও হাঁটে, খালি পায়ে হাঁটে, খালি পেটে হাঁটে, কাজ বন্ধ করে হাঁটে, বাড়ির যা কিছু 
সম্পদ সব বিক্রি করেও হাঁটে, হাঁটায় সাধারণ অসাধারণ।

সবাই লড়াকু, সংগ্রামী, দেশপ্রেমিক। সাংবিধানিক কায়দা মেনে পথ খোঁজে। জনগণের প্রেমনদীতে সাঁতার কাটে ওরা, তাতে প্রেমের নামে প্রেমীর কাপড় খোলে; পতাকার পেটে পতাকা জন্মায়, বদরঙা।

জনগণের টাকা। হাজার হাজার কোটি টাকা। রাজনৈতিক বস্ত্র ক্রয় করছে রাজনৈতিক দল। শুটিং। জনে জনে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে-- 'বুক চিরে ভালোবাসি'। সাধারণ ঠিক জানে-- এ সময় 'ভালো' বাসাবাসিতে সময় শ্রম অর্থ সবই শেষ, বিনিময়ে কিছু সুবিধাভোগীর জন্য ভোট বেরোবে নাহয় রক্ত... ।

শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭

ত্রিভুজ

।। অভীক কুমার দে।।

(C)Image:ছবি













মন ঢাল বেয়ে হেঁটে যেতেন বাবা
তারও আগে হেঁটেছেন কেউ অথবা অনেক
এখন আমি।
চূড়ায় পাহাড় স্টেশন
তারপর পথের কোন উপরিপথ নেই,
যেখানে উচ্চতা শেষ আকাশের বুক ফোঁড়ে বিন্দু
স্থির থাকে না শরীর।
বাবাকে গড়িয়ে পড়তে দেখে
আমিও পা রাখি পাহাড়ি পথে,
পায়ের পর পা উপরে উঠছি যতই
 
বাবা উল্টো দিকে...
সমতল থেকে চেয়ে থাকে মা
স্থির দৃষ্টি থেকে দু'টো নদী বেঁকে যায় দুদিকে,
এক নদী প্রসবের রক্ত মোছে আরেক নদী সিঁথি...
......................

শীতকেই ভালোবাসি









।। সিক্তা বিশ্বাস।।

শীতের দেশের কন্যে আমি
শীতকে দারুণ চিনি ---
হাড়কাঁপানো ঠক ঠকানো
শীতকেই ভালো জানি l
গ্রীষ্ম হেসে বললে আমায় ,
গাল পেড়েছিলে ,ভুলিনি তোমায় ,
এবার কাঁপো শীতের জন্যে
 
খোঁজো আমায় হয়ে হন্যে !
হাসি আমি মনে মনে ,
শীতের আমেজ ক'জন জানে !
হিমেল শীতের বরফ বৃষ্টি
 
প্রকৃতির এক অমোঘ সৃষ্টি l
বললাম হেসে ,
সুয্যিমামা দেয়না ফাঁকি ,
কোনকালেই পড়েনা বাকি !
তোমার তালে যেমনি চলে
 
শীতের কালেও কথা বলে l
তাইতো,
আমার শীত হিমেল হাওয়ার কমলাবনে ,
বাহারি রূপে --- হলুদ পাতার সবুজ বনে
 
পড়াশুনা বিহীন
  ছুটির দিনে ,
 চাই যে তারে  মনের কোণে l
শীত যে আমার গরম পশমে ,
গল্পের বই আর চিনে বাদামে ,
লেপ-কম্বলে মোড়া উষ্ণতার আরামে
  
কিংবা গরম চায়ের পেয়ালা চুমে
  l
আমার শীত যে পিঠে-পুলির আমেজি দিনে 
নেশা লাগায় কুল,জলপাই আর আমলকীবনে
 
শুকনো পাতার মর্মরে শির্ শিরে শব্দবাণে
কিংবা বেদুইন মনের বন্-ফায়ারের বনভোজনে l
আমার শীত শৈল-শহরের সাজের দিনে 
সান্তাক্লজের
  ' বড়দিন ' এর আনন্দ দিনে 
উজ্জ্বল আলোর রাশির
  শহর তলে ,
জিঙ্গলবেল এর ক্রিস্টমাস ক্যারলে ll
  ##ঝোড়োমেঘ সংকলন ##
       শিলং l

শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭

শক্ থেরাপি




























।। অর্পিতা আচার্য ।।

তীব্র আলো নিপীড়িত ঘরে,
ওষুধের ঝিম ধরা ঘ্রাণ -
অসীম মাঠের মত খোলা এক বিরহ টেবিল 
সে টেবিলে শুয়ে আছে
প্রত্যাখ্যান জর্জরিত চন্দ্রাহত দেহ
দুই পাশে ইলেকট্রোড, সামনে মনিটর
চঞ্চল আঙ্গুলে শুধু জীবনের অসহ্য দোলন
সে চালনে মুহূর্তেই কেঁপে উঠবে মৃত অক্ষিপট
শরীর আছড়াবে এই নিরাসক্ত অস্থির টেবিলে
সেকেন্ডের দশ ভাগ, চারশো ষাট
উদ্দাম ভোল্টেজ
সহস্র গ্যালাক্সি যেন হাউইয়ের মত
ছুটে যাবে ক্ষিপ্র এক বিদ্যুৎ তরঙ্গে
যে ছিল মানুষ, হয়তো -
মরে গিয়ে বেঁচে উঠবে
মস্তিষ্ক বিহীন কোন অর্ধমৃত
নিঃস্ব রিক্ত বেশে


বৃহস্পতিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭

সোজা কথা

                        
             ।।       রফিক উদ্দিন লস্কর     ।।

(C)Image:ছবি










ব্যথা আমার কতটুকু যদি জানতে চাও হে প্রিয়,
তবে খাঁচায় বন্দী কোনো পাখির কাছে জেনে নিও।
দেখতে চাও যদি আমার ভিজে যাওয়া চোখ দুটা,
তবে দেখে নিও জলে ডোবা কোনো পদ্মফুল ফোটা।
আগ্নেয়গিরিকে প্রশ্ন করো না কেন সে ঘুমিয়ে আছে,
বোবা মুখে চেয়ে থাকবে জবাব পাবে কি তার কাছে!
আর্তের বেদন কভু কি দেখেছো অতি কাছে থেকে,
দেখতে পারো ডানা ভাঙা ভ্রমরকে হাতে তুলে রেখে।
গুনতে চেয়োনা আকাশের তারা খুঁজে পাবে না শেষ,
গোনা যাবে না আমারই ব্যথা কেউ করবেনা পেশ।
যদি কোনদিন গোপন করতে চাও আমাদের পরিচয়,
ভোরের কুয়াশা দিয়ে ঢেকে দিও তাতে মন্দ কিছু নয়।
                                *********
২১/১২/২০১৭ইং
নিতাইনগর, হাইলাকান্দি (আসাম-ভারত)

বুধবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৭

আলো হয়ে এসো

।। অভীক কুমার দে।।








বিকে পথ দেখাবে যদি
আলো হয়ে এসো,
নরম আলো;
রশ্মিরকম জ্বালানি ঢেলো না পথে।
জানোই তো কবিতে কবিতা থাকে,
জ্বলে উঠবে,
নিজেই পোড়াতে পারো।
..................

শব্দসোহাগ

।। অভীক কুমার দে।।

(C)Image:ছবি



















লেখা হচ্ছে না
লেখা আসছে না
শব্দ সব শব্দ করতে করতে 

মনের মেঘলা দুয়ার ঠেলে
উড়োজাহাজের মতোই লুকিয়ে নিঃশব্দ,
আসলে এমন সময় প্রসবের প্রাক্কাল
ভীষণ ব্যথা এ সময়
সহ্য করতে হবে
অনেক কষ্টের ফুল ফোটানো সোহাগ শব্দের।
...........

মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭

সিনেমা দেখতে গিয়ে


।। শিবানী ভট্টাচার্য দে।।

(C)Image:ছবি
ঠাৎ ছপ্পরফাঁড় দুটো আইনক্সের টিকিট পেয়ে গেলাম কিছু গয়না কেনা হয়েছিল মেয়ের আসন্ন বিয়ের প্রয়োজনে কেনাকাটা ত্রিশ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সেদিনকার প্রেফারড কাস্টমার-এর ডিসকাউন্ট হিসেবে আমার ভাগ্যে এভাবেই আইনক্সের একশ পঁচাত্তর টাকা দামের দুটো টিকিট জুটে গেল 
            ভেবেছিলাম কর্তাগিন্নি দুজনে যেতে পারব, কিন্তু যেদিনকার শো, সেদিনের জন্য তাঁর ব্যস্ততা থাকবে কন্যার ও তথৈব চ দুজনের কেউই যেতে পারবেন না তাঁদের কর্তব্যনিষ্ঠার দায়ে আমাকে অনেক সময়েই একা একা বাজার করতে হয়, এমন কি সিনেমা যেতে ইচ্ছে করলেও আমি একাই যাই যে তল্লাটে আমার বর্তমান বাসস্থান, সেটা পুরোপুরি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এলাকা তবে সেখানে আমার কোনো  বিশেষ বন্ধু নেই প্রতিবেশিনীদের সঙ্গে দুএক বার কথা বলে দেখেছি, টিভির সান্ধ্য প্রোগ্রাম ছেড়ে তাঁরা সিনেমা যেতে উৎসাহী নন, তায় আবার এতো টাকা খরচ করে যেখানে টিকিট কিনতে হয়, যাতায়াতের কড়ি গুনতে হয়, সে ব্যাপারকে শুধু ওঁরা নয়, তাঁদের কর্তারাও বাজে খরচ বলে মনে করেন আমার ব্যাপারটা একটু অন্য, আমি বরং অন্য খরচ কমাব, কিন্তু ভালো ছবি এলে হলে দেখতে যাব, আমার বাড়িতেও এটা সবাই জানে  
            এখন আমার পরিবারের কেউ যেতে না পারার জন্য একটা টিকিট নষ্ট হতে দিতে খারাপ লাগছে বিশেষ  করে যখন একটা ভালো বাংলা ছবি চলছে কাকে নেওয়া  যায়? আমার নিকটবর্তী প্রতিবেশিনী সকলেই  আমার চাইতে বয়সে কিছু বেশি, মোটামুটি পরিচয় ও সাধারণ কথাবার্তার সম্বন্ধ আছে ভেবেচিন্তে একতলার চারের বাসিন্দা সুপর্ণা বসুর কথা মনে হল  ভদ্রমহিলার বয়স আন্দাজ পঁয়ষট্টি, বেশ সুন্দর করে কথা বলেন, বেশভূষায় এখনো  বেশ সুরুচিসম্পন্ন, ভালোই লাগে আমার  ইনি হয়তো যেতে পারেন, মুভি উপভোগ করতে পারেন, বাকি যে আরো দুজন মোটামুটি আমার ফ্ল্যাটের কাছাকাছি আছেন,  তারা নিতান্তই ঘরোয়া কাজে জড়ানো মানুষ, ওঁদের  কেউই  সন্ধ্যেয় তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় বের  করে যেতে পারবেন কিনা সন্দেহ আমার কাছে একটাই মাত্র বাড়তি টিকিট, একজনকেই নিতে  হবে
            সুপর্ণা বসুর সঙ্গে কথা বললাম, উনি চট করে হাঁ বললেন না, অন্যের অযাচিত দান নিতে একটু কিন্তু  কিন্তু লাগেই, লোকে একটু সন্দেহের চোখে দেখে তারপর তাঁর হাঁটুর ব্যথা আছে, তিনি বেশি হাঁটতে পারেন না তায় উনি নাকি অন্তত ৪০বৎসর হলে  সিনেমা দেখেনইনি! যা দেখেছেন, তাঁর বিয়ের আগে সারাজীবন ঘেরাটোপে থেকেছেন, বাপের পর স্বামী তাঁর দায়িত্ব নিয়েছে, স্বামী এখন বৃদ্ধ, এরপর ছেলে তাঁর দায়িত্ব নেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কিন্তু কেউই জিগ্যেস করেনি তাঁর আলাদা কোনো চাহিদা আছে কি না, বিশ্বাস করেনি যে তিনি নিজে কোনো দায়িত্ব নিতে পারেন যতটুকু সম্ভব ঘরের কাজকর্ম, পুজোপ্রার্থনা, ফোনে আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর, সব শেষে সন্ধ্যেবেলায় মাঠের বেঞ্চিতে বসে আরো কয়েক জন মহিলার সঙ্গে আড্ডা,---  যে আড্ডায় মূল আলোচ্য বিষয়বস্তু হল নিজেদের স্বাস্থ্য, রান্নার রেসিপি, টিভি সিরিয়ালের আলোচনা, বাড়ির কাজের লোকেদের কাজকর্ম গতিপ্রকৃতি, আর যেহেতু এঁরা সকলেই প্রৌঢ়ত্বের মধ্য বা প্রান্তসীমায়, তাই কখনোসকনো পুত্রবধূদের নিন্দা, তবে নিজের সন্তানের কথায় সব সময়ই ভালো দিকটা উঠে আসে---এই করেই তাঁর সময় কাটে সুপর্ণা বসুর সেই বদ্ধ পুকুরে আমি সিনেমা যাবার প্রস্তাবের ঢিল ফেললাম
            তিনি প্রথম দিন বললেন, ভেবে দেখি যেহেতু সময় আছে হাতে দুদিন, তিনি ভেবে দেখতেই পারেন, না যান তো একটা টিকিট নষ্ট হবে, আমি আমারটা নিয়ে একাই যাব, আর কাউকে বলব না, স্থির করেছি যা হোক, পরের দিন তিনি ফোন করে তাঁর সম্মতি জানালেন, বুঝলাম, তাঁর বাড়ির লোকজন, মানে পতিপুত্র, তাঁকে অ্যাডভেঞ্চার করতে দিতে রাজি হয়েছেন! 
            সিনেমা দেখার পরদিন সকাল দশটা নাগাদ
            ‘’কাল আপনার মিসেস নাকি হারিয়ে গিয়েছিলেন?” আমার বাজারফেরত বরের উদ্দেশে প্রশ্নটা করলেন  অঞ্জনা দাস, আমাদের দোতলার প্রতিবেশিনী উনিও বয়স্কা, দেখা হলে কেমন আছেন ইত্যাদি বলেন, ভদ্রলোকও যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর করেন, ব্যস, এইটুকুই কথোপকথন হয় কখনোসকনো 
            তো ভদ্রলোক একটু থতমত খেয়ে উলটো জিগ্যেস করলেন, তাই নাকি? আমি তো জানিনা, কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল ?
আপনি জানেন না? আপনাকে বলেনি কিছু? কেউই ফোন করে নাকি পাচ্ছিল না
না, আমাকে কেউ কিছু বলেনি
আপনি বাড়িতে ছিলেন না বোধহয় শুনেছিলাম উনি আইনক্স গিয়েছিলেন  কিন্তু উনার খোঁজ সন্ধ্যে থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না, ফোন ছিল সুইচড অফ
, তাই বলুন ও তো মাঝেমাঝে  নতুন ছবি এলে দেখতে আইনক্সে যায় সিটি সেন্টার জায়গাটা তো খুব দূরে নয় ওখানে হারিয়ে যাবার কি আছে? রাস্তা তো একটাই
অঞ্জনা দাস মুখরোচক খবরটা কে জানে কোত্থেকে পেলেন, না দুইয়ে দুইয়ে চার করে বানালেন, ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন না আর বাক্যব্যয় না করে বাড়ি ফিরে তিনি বউকে জিগ্যেস করলেন, কী গো,  কালকে তুমি নাকি হারিয়ে গিয়েছিলে ?
কে সংবাদটা দিল? 
দোতলার মিসেস দাস
হারিয়ে গেলে খুঁজে আনল কে ?
জানি না, সারা পাড়া নাকি চিন্তিত ছিল তুমি হারিয়ে গেছ
কী মুস্কিল আইনক্সে তো এই প্রথম যাচ্ছি না, তাও এবারে একা নয়, সঙ্গী নিয়ে গেছি সে শুদ্ধু হারিয়ে গেলাম ?
কাল একতলার দুইয়ের মুখার্জি সন্ধ্যেবেলায় ফোন করেছিল জিগ্যেস করেছিল আমি কোথায় আছি চেম্বারে আছি শুনে বলল, তাহলে এখন থাক এখন বুঝলাম, এই ব্যাপারেই করেছিল নাহলে ও মিছেমিছি ফোন করবে কেন ! 
বুঝলাম ব্যাপারটা, প্রতিবেশী কাউকে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হয় নি, একা যাওয়াই উচিত ছিল
কেন?”
          কারণ এতক্ষণে আমি ব্যাপারটা ধরতে পেরেছি তোমাকে বলেইছিলাম সুপর্ণাদি যাবেন কিনা বলতে  দুদিন সময় নিয়েছেন উনি নাকি, ওর বিয়ের পর, মানে গত প্রায় চল্লিশ বছর সিনেমা হলে যাননি ওনার ছেলে গাড়িতে করে আমাদের দুজনকেই পৌছে দিয়ে এলো, ফেরবার সময় ও এসে নিয়ে যাবে বলল হলের ভেতর তো আমার মোবাইল সাইলেন্ট করে ব্যাগে রাখা থাকে, ওখানে কথা বলতে ভালো লাগে না, আর আমি আগেই যাদের কাছ থেকে কল আসার সম্ভাবনা, তাদের জানিয়ে দিয়েছি আমি আজ সিনেমা দেখতে যাব সিনেমা শেষ হবার পর আমার মোবাইলে দেখলাম, চারখানা মিস্ড্ কল, সবই প্রায় আধঘণ্টার ব্যবধানে,  ওনার বাড়ি থেকে বুঝলাম পতিপুত্র দুশ্চিন্তায় ভুগছেন ওনার জন্য তাই সঙ্গে সঙ্গেই ওনার সঙ্গে ওনার ছেলের যোগাযোগ করিয়ে দিলাম  সে নিচে অপেক্ষা করছে গাড়ি নিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা হতেই সে বলল, এত দেরি কেন, আমি আধঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি আর কতবার ফোন করা হয়েছে, বাবা খুব দুশ্চিন্তা করছে
            আমি সুপর্ণাদিকে বললাম, “ইন্টারভেলে আপনি বাড়িতে একটা কল করে দিলে ওনারা চিন্তায় থাকতেন না
উনি একটু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “আমার মোবাইল ব্যবহার করতে  অসুবিধে হয় তাই আমি নিই না বাড়িতে ল্যান্ডফোন তো আছেই, আর আমি সাধারণত বাড়ির কারো সাথেই বাইরে যাই
আমি এতসব জানতাম না  বাড়ির লোকজন এত উদ্বিগ্ন হবে উনিও হয়তো ভাবেন নি আমার আরো খারাপ লাগল ভেবে যে এই সাধারণ প্রযুক্তিটুকুও তাঁকে বাড়ির লোকে শেখায়নি
আমি আরো ভাবলাম, তাহলে সুপর্ণাদির ছেলেটা এবং তার বাবাও কি কোনোদিন সিনেমাহলে যায় নি! হায় ভগবান, ঋতুপর্ণ ঘোষ, কৌশিক  গাঙুলি, সৃজিত মুখার্জিরা তাহলে কাদের জন্য সিনেমা বানালেন /বানাচ্ছেন‌! একটা যুবক, ইঞ্জিনিয়ার, মাসে নাহোক দেড়লাখ টাকা মাইনে, এবং তার বাবা, ভূতপূর্ব প্রফেসর, কখনো সিনেমা হলে যায়নি, তারা তাদের নিজেদের জগতে ব্যস্ত থাকে এরা তাই জানেনা, হলে  ছবির শোর প্রথম দিকে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন থাকে, শুরু হতে অল্প দেরি হয়, শেষটায় বেরোনোর সময় ধরে আড়াই ঘণ্টা মত সময় ছোট ছবি হলেও প্রায়ই লাগে অথচ এটুকু জানলেই আর দুশ্চিন্তা করতে হত না আর সিনেমা হলে শো-এর সময় মোবাইল বন্ধ রাখাই  উচিত, কথা বলা অশিষ্টতা 
            আমার বর বললেন, “আহা, রাগ করছ কেন? কেউ সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখেনি এটা কি ওদের দোষ?ওদের এন্টারটেইনমেন্টের রুচি আলাদা আর ওরা ওদের নিজের জনের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এটাতেও তো দোষের কিছু নেই 
দোষের কথা হচ্ছে না আমার আশ্চর্য লাগে যে এই যে আমাদের আশেপাশের ভদ্রমহিলারা, যাদের স্কুলকলেজের কিছু পড়াশোনা আছে, তাদের অনেকেই এখনো মোবাইলের ব্যবহার জানেন না, বড়জোর কল রিসিভ করা ছাড়া কাউকে কল করতে হলে ওঁদের অন্যের সাহায্য লাগে উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটির নাম খুঁজে দেবার জন্য, এতো আমি হামেশাই দেখি  এই যে বাড়ির লোক, ওঁদের স্বামী-ছেলে-মেয়ে, যারা মহিলাটির জন্য এত উদ্বিগ্ন, তারা তো মহিলাটির খবর জানবার জন্য এইটুকু করতে পারত, মোবাইলের ব্যবহারটুকু শিখিয়ে দিতে পারত  আজকাল কাজের লোকেদের মধ্যেও অনেকে মোবাইল ব্যবহার করতে জানে তারা বেশ শিখে যায় কিন্তু অনেক শিক্ষিত ভদ্রলোকই নিজেদের বাড়ির বয়স্ক মহিলাদের হাতে ধরে কোনো  প্রযুক্তি শেখাতে চান না, তারা যদি শিখতে গিয়ে ভুল করেন, (করতেই পারে, কারণ অনেক বছরের নতুন কোনো বিদ্যাশিক্ষার অনভ্যাস), তখন খেঁকিয়ে ওঠেন, সেই খেঁকানোর চোটে অসম্মানিত মহিলাটির আর শেখাটাই হয়ে ওঠে না আবার তিনি সেই  কাজটা জানেন না বলে খোঁটা দিতেও  ছাড়েন না এই ভদ্রলোকেরা কখনো নিজের খুশিমত বাইরে না যাওয়া এই মহিলাদের কিছু দায়িত্ব দিয়ে ঘরের বাইরে পাঠাতে  পারতেন, অন্তত সিনেমা যাওয়ার, ছোটখাটো বাজার করার অভ্যাস থাকলেও মহিলাটি নিজেই রাস্তা চিনে বেরোতে পারতেন, বাড়ি একা একা ফিরতে পারতেন, ওঁদের এত চিন্তা করতে হতো না  শুধু নিজের লোকের চিন্তা নয়, ওঁরা ওঁদের স্ট্যান্ডার্ডে চিন্তা করে আমিও হারিয়ে গেছি ভেবে  প্রতিবেশীদের কাছেও উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেলেছেন!”
            সেদি্নকার মত আমাদের এবিষয়ে আলোচনা শেষ হল কিন্তু কথাটা আমার মনে সব সময়ই খচখচ করে এখন যারা মধ্যবিত্ত সমাজে মধ্যবয়স্ক, প্রৌঢ়, সেইসমস্ত মেয়েদের অনেকেই বিয়ের আগে কিছুটা লেখাপড়া করেছিলেন, কিন্তু চাকরি করতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি, পড়াশুনো শেষ হতে না হতেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বিয়ের পর নতুন সংসারে মানাতে গিয়ে তারা জীবনের যাকিছু নিজস্ব  ভালোলাগা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, সব কিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেকে কাদার তালের মত করে ফেলেছিলেন স্বামী সন্তান সংসারই হয়ে ওঠে ধ্যান জ্ঞান বাড়ির বাইরে একা যাবার সাহসই করে উঠতে পারেন নি, অথবা অশান্তির ভয়ে যাবার চেষ্টা করেননি দ্রুত পরিবর্তনশীল এই জেটযুগে যখন দুনিয়া ছুটছে, সন্তানেরা তো অল্প বয়স থেকে তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, স্বামী তাঁর চেয়ে বয়সে বড় হলেও যেহেতু তাঁর বাইরের জীবন আছে, নতুন প্রযুক্তি, নতুন শিক্ষা কিছুটা হলেও রপ্ত করছেন; অবসরজীবনে স্বামী  কম্প্যুটারের সামনে বিনোদনে বসে আছেন কিন্তু মহিলারা এই জীবনের বাইরে থাকছেন মহিলারা যারা এতদিন শিক্ষার ব্যাপার থেকে দূরে ছিলেন অনিবার্য কারণে, তারা নতুন  প্রযুক্তিকে ভয় পাচ্ছেন; কেউ বা একসময় শিখতে চেষ্টা করলেও সময় লাগছে, তিনি কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে যে শিখবেন সেই সুযোগ তাঁকে দেওয়া হচ্ছে না, বাড়ির লোকে তাঁকে সাহায্য করছে না, অনেক সময় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে  দেওয়া হচ্ছে, তুমি আর ওসব শিখে কী করবে, আর সময় সময় তাঁর অক্ষমতা নিয়ে বিদ্রূপ করা হচ্ছে অভিমানে, লজ্জায় মহিলাটি আর প্রযুক্তির দিকে, নতুন কিছু জানার  দিকে ঘেঁষছেন না, সময় কাটাচ্ছেন সেই গতানুগতিক গৃহকর্মে, টিভি্তে জীবনের সঙ্গে যোগসূত্রহীন অদ্ভুত সব সিরিয়াল দেখে, পিএনপিসি করে, আর পুজোঅর্চনায়  অনেক মহিলা টিভি চালানো ছাড়া অন্য কোনো গৃহকর্মের সহায়ক বৈদ্যুতিন যন্ত্রকে ভয় পান এরকম দেখা যায়, কাপড় কাচার মেশিন, মাইক্রোওয়েভ চুল্লী, ইত্যাদিতে সামান্য যে কন্ট্রোল বাটন  টিপে  অ্যাডজাস্ট করতে হয়, সেই ভয়ে অনেক মহিলা এইসব যন্ত্র কিনতে রাজি হন না, কষ্ট করে নিজেরা হাতে কাজ করেন  নয়তো কাজের লোককে দিয়ে করান, আর মেশিনগুলো বাড়িতে থাকলে তাঁদের স্বামী/ছেলে/মেয়ে অবসরমত এগুলো চালান একই  ভাবে মোবাইলে শুধুমাত্র কেউ কল করলে তা হয়তো রিসিভ করেন, কিন্তু মোবাইল ঘেঁটে কন্ট্যাক্ট নম্বর খোঁজা, নাম নম্বর সেভ করা, মেসেজ করার মত সাধারণ কাজ ও অনেকে জানেন না অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল বা অন্য কোনো উন্নততর প্রযুক্তি, কম্প্যুটার,  ইত্যাদির প্রশ্নই আসে না আরেকটা কারণ যেজন্য এঁরা ভয় পান, তা হল, আনাড়ি হাতে যদি দামি জিনিষটা নষ্ট হয়ে যায়!  স্বামীর হাতে খারাপ হলে স্ত্রীর কাছে তার জন্য জবাবদিহি করতে হয় না, কারণ জিনিসটা স্বামীর পয়সায়  কেনা ছেলেমেয়ের হাতে খারাপ হলে, যুক্তি হল, তারা তো ছোট, কম বয়স, তাদের হাতে হতেই পারে কিন্তু  মহিলাটির হাতে সামান্য এদিক ওদিক হলে তাঁকে   কথা শুনতে হয়, ধরে নেওয়া হয় তাঁর আনাড়িপনার জন্যই জিনিসটা খারাপ হয়েছে, অন্যদিকে, তাঁর ক্ষতিপূরণ  দেবার মত সামর্থ্য নেই তাঁর টাকা নেই, আর যদি থাকেও, বাজারে গিয়ে দেখেশুনে কেনবার মত চৌকস তিনি নন
            তিনি খবরের কাগজ হাতে পান সকলের পড়া শেষ হবার পর, প্রায়ই বিকেলে প্রায়ই অন্য কাজকর্ম শেষ করে তাঁর আর কাগজ ভাল করে পড়ার সময়ই হয় না বা ইচ্ছে থাকে না যদি বাইরের জগত সম্পর্কে কোনো কথা জিগ্যেস বা মন্তব্য করে ফেলেন, তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়না, হাল্কা জবাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়, নাহয় বলা হয়, তুমি ওসব বুঝবে না বাড়ির অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত তাঁর হয় না।  তিনি জেনে  যান, নিজের জনের কাছেও তাঁর কোনো গুরুত্ব নেই
এইভাবে কত বয়স্ক মহিলা যাদের বাইরে থেকে তৃপ্ত পত্নী, সম্মানিত জননী, প্রতাপশালী গৃহিণী মনে হয়, ভেতরে ভেতরে তাদের অবস্থা খুবই ভঙ্গুর সেই ভঙ্গুর অবস্থা থেকে বাঁচতে মহিলাটি যাবতীয় কুসংস্কার, ধর্মবাতিক, পুরোনো মূল্যবোধের নামে শতশতাব্দীপ্রাচীন প্রথা, নিয়ম আঁকড়ে ধরেন,  মনকে   চারদিক থেকে বন্ধ করে নিজে সেগুলো মানেন, কাছের জনদের মানতে পীড়াপীড়ি করেন সারাজীবন নিজে বঞ্চিত থাকার দরুন শেষবয়সে তাঁর মনে হতে থাকে সকলে তাঁকে ঠকাচ্ছে, তাই স্বার্থপর হয়ে ওঠেন ঘরের সম্মানরক্ষার নামে, সংস্কাররক্ষার নামে, বা যেকোনো ছোটখাটো অজুহাতে বাড়ির দুর্বলতর ব্যক্তি যেমন পুত্রবধূর উপর অত্যাচার করেন, খাণ্ডারনি গিন্নির ক্যাচক্যাচানিতে গৃহকর্মী বাড়িতে টিকে থাকতে পারে না  এরপর পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে ঝগড়ুটে মহিলা, সন্তান বা  নাতিনাতনির কাছে অশিক্ষিত বিদ্রূপযোগ্য বুড়িতে পরিণত হওয়া খুবই  স্বাভাবিক ঘটনা  আর যারা নরমস্বভাব থাকেন, জীবনকে মেনে নিয়ে চলেন, তাঁরা হন করুণার পাত্র, তাঁরা সইতেই থাকেন, শুধুমাত্র বঞ্চনাই জোটে সারা জীবনে ও হ্যাঁ, এঁরা অবশ্য ভারতীয় নারীর আদর্শ হয়ে যান
সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখে পাশে দাঁড়ানোর জন্য মহিলাটি অনেক ক্ষেত্রেই কাউকে পান না, তাঁর তথাকথিত সুখদুঃখের  সাথী স্বামীকেও নয় ছেলেমেয়ের সঙ্গে মানসিকতার আকাশপাতাল ফারাক হয়ে যায়  আবার, কিছু কিছু তথাকথিত শিক্ষিত লোকজন নারীর এই মানসিকতার ভঙ্গুরত্বকে তার রজোনিবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত করেন, মানে দোষ মহিলাটিরই, তাঁর মানসিক এবং শারীরিক,  সমাজ পরিবার কারো কিছু করবার নেই
এই আমাদের বেশিরভাগ মা, কাকিমা, মাসিমা পিসিমাদের জীবনকাহিনি